রক্তদান করুন
সব রক্তের রং লাল
স্বাগত
আশা করি আপনারা সবাই নিরাপদে আছেন এবং পরিবারের সঙ্গে ভালো আছেন।
আমি তিলক গুপ্ত—পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, মনেপ্রাণে সঙ্গীতপ্রেমী ও অপেশাদার সঙ্গীতশিল্পী। আমার সংগীতযাত্রার কিছু মুহূর্ত এবং আমার আগ্রহের কিছু দিক আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
আমার শৈশব কেটেছে সঙ্গীতের আবহে। আমার প্রথম গুরু ছিলেন আমার বাবা। তিনি আমাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং হিমাংশু দত্তের গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আচার্য চিন্ময় লাহিড়ী ও তাঁর পুত্র শ্যামল লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়ার সৌভাগ্য হয়। পাশাপাশি কলকাতার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান 'গীতবিতান' থেকে 'গীতাভারতী' ডিগ্রি অর্জন করি।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার আগ্রহে, আমি প্রশিক্ষণ পেয়েছি দুইজন কিংবদন্তি গুরুর — সুবিনয় রায় ও মায়া সেন-এর কাছে। খ্যাতনামা সঙ্গীত গোষ্ঠী 'ইন্দিরা'র সাথে যুক্ত হবার সুবাদে সুভাষ চৌধুরী, ঋতু গুহ, অর্ঘ্য সেন এবং আরও বিশিষ্ট জনের সান্নিধ্য পেয়েছি।
বাংলা আধুনিক গান বা 'আধুনিক গান' আমার বরাবরের আগ্রহের ক্ষেত্র। ছোটবেলা থেকেই গ্রামোফোন রেকর্ড, ক্যাসেট এবং বিশেষত অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সম্প্রচার আমার সঙ্গীতচেতনা ও রুচিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই ধারায় অল্প সময়ের জন্য হলেও, আমি প্রশিক্ষণ পেয়েছি বিমান মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।
তবে পেশাগত দায়বদ্ধতার কারণে কিছু বছর সঙ্গীতচর্চায় বিরতি পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে, আমার বন্ধু সুজয় সরকারের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সুজয় আমাকে আবার সঙ্গীতের সঙ্গে পুনঃসংযোগ করায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সুজয়কে আমরা অকালে হারিয়েছি ।
আমার এই সংগীতযাত্রায়, হলদিয়া উৎসব, কসবা উৎসব, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং পশ্চিমবঙ্গ বইমেলার মতো নানা সম্মানজনক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। শুভেন্দু মাইতি, সংঘমিত্রা গুপ্ত এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করার সুযোগও আমার হয়েছে। বিশেষভাবে, শ্রী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। তাঁর সান্নিধ্য আমাকে বহু দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে।
আমার পরিবেশনা সম্প্রচারিত হয়েছে আকাশবাণী, দূরদর্শন এবং শীর্ষস্থানীয় এফএম রেডিও চ্যানেল থেকে। ২০১২ সালে, সহশিল্পী সারা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে "অনন্য মিউজিক" লেবেল থেকে আমার প্রথম সিডি অ্যালবাম "অঙ্গে বাজিছে বাঁশি" প্রকাশিত হয়।
প্রায় দুই দশক পর, ২০১৫ সালে আমি আবার সঙ্গীত শিক্ষায় ফিরে আসি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমার শেখার সুযোগ হয় কিংবদন্তি কবীর সুমনের কাছে। তাঁর সঙ্গে এই যাত্রা আমার সঙ্গীতজীবনে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। এখানে শেখা মানে শুধু গান বা রাগ রপ্ত করা নয়—বরং সঙ্গীতকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার, ভাবার ও অনুভব করার অভিজ্ঞতা। প্রতিটি গান বা কম্পোজিশনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক প্রেক্ষাপট তিনি যেভাবে বিশ্লেষণ করেন, তা এক অনন্য শিক্ষার জগৎ উন্মোচন করে। তাঁর কাছে শিক্ষা নিয়ে আমি অনুভব করি—সঙ্গীত আসলে জীবনের সর্বত্র বিরাজমান। এমন একটি অভিজ্ঞতার অংশ হতে পারা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম সৌভাগ্য। আমার সংগীত জীবনের অন্যতম গর্বের মুহূর্ত ছিল ২০১৭ সালের ২২শে এপ্রিল, কলাকুঞ্জ প্রেক্ষাগৃহে কবীর সুমনের কালজয়ী অ্যালবাম "তোমাকে চাই"-এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া। সত্যি, সে এক স্বপ্নপূরণের অনুভূতি।
আমার শিক্ষাজীবনের শুরু ‘আলোর পরশ’ নামে একটি নার্সারি স্কুলে। এরপর জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন ও নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস স্কুল থেকে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে নেতাজি নগর ডে কলেজ থেকে স্নাতক হই। পরবর্তীতে ‘আপট্রন একাডেমি অফ কম্পিউটার লার্নিং’ থেকে আমি কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তিতে অ্যাডভান্সড পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা অর্জন করি। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাকে যে ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে গড়ে তুলেছে, তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
আমার বাবা, আমার জীবনের চিরন্তন অনুপ্রেরণা, বিভূতিনাথ গুপ্ত (২১ আগস্ট ১৯২৫ – ১৬ জানুয়ারি ২০১১), ছিলেন একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ছিলেন এক আদর্শবান মানুষ, ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিম যাত্রার সাক্ষী—এই অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আমার মা, ইন্দিরা গুপ্ত (২০ আগস্ট ১৯৩৩ – ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯), ছিলেন একজন প্রগাঢ় পাঠক, সুদক্ষ লেখিকা এবং একজন নিবেদিত গৃহিণী। তাঁর লেখা কবিতা ও প্রবন্ধ ‘সন্দেশ’, ‘দেশ’ ও ‘যুগান্তর’-এর মতো খ্যাতনামা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমার প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ উৎসাহ ও অগাধ বিশ্বাস আমার প্রতিটি সাফল্যের ভিত্তি।
গোপা (২৭ জুন ১৯৭৪ – ৩০ এপ্রিল ২০২১) আমার জীবনসঙ্গী হন ১৯৯৬ সালে। এক সরল , হাসিখুশি, ভালোবাসায় ভরা মানুষ ও অসাধারণ মা। কোভিড-১৯ মহামারির সময় আমরা তাঁকে হারাই। গোপার স্মৃতি আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে আজও জীবন্ত।
আমাদের মেয়ে দময়ন্তী (টুপুর)-র জন্ম ১৯৯৮ সালে। টুপুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেএডুকেশনে স্নাতকোত্তর এবং বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেছে। বর্তমানে একটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছে। ওর চোখ দিয়ে আমি আবার নতুন করে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করি।
পরিশেষে, আমার সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, সহকর্মী, সহশিল্পী, রেকর্ডিস্ট এবং যাঁরা সবসময় আমাকে সংগীত নিয়ে এগিয়ে চলতে উৎসাহিত করছেন তাঁদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।